search

Sunday, April 22, 2012

ইতিহাসের খোঁজে – দিল্লি - প্রথম পর্ব

দিল্লির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, শত শত বছরের কত সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের সাক্ষী এই শহর। আজ শুধু ইংরেজদের রাজধানী স্থাপনের একশ বছর পূর্ণ করার জন্য হইচই হচ্ছে, কিন্তু একশ বছর দিল্লির ইতিহাসের খুবই নগণ্য অধ্যায়। দিল্লির ভৌগলিক অবস্থানের জন্য যুগে যুগে রাজা, সুলতান, সম্রাটদের একমাত্র পছন্দের স্থান ছিল রাজধানী এবং স্ট্রাটেজিক পয়েন্ট হিসাবে। ভারতের মানচিত্রে লক্ষ করলে দেখা যাবে দিল্লির অবস্থান ঠিক সিন্ধু উপত্যকার প্রান্তে, উত্তর পশ্চিম সীমান্তের গিরিপথগুলির সীমানায়, হিমালয় পর্বতমালা আর তার উপত্যকা ও রাজস্থানের মরুভূমির যোগাযোগস্থলে, পূর্বে গঙ্গা-যমুনার দোয়াবের শষ্যশ্যামল উপত্যকা, আর দক্ষিণে মধ্যভারতের ঘন অরণ্যময় বিন্ধ্যাচল ও তৎপরবর্তী তিন সাগরে ঘেরা সমগ্র দক্ষিণ ভারত। এই কারনে যুগে যুগে দিল্লি হয়ে উঠেছিল ভারতের সম্পদের লোভে আসা বিদেশীদের প্রথম পছন্দ, তাই বারবার রাজসিংহাসন পরিণত হয়েছে তখত-এ, তাতে সময়ের কালচক্রে একের পর এক সুলতান, সম্রাট বসেছেন সেই রাজধানীতে, বানিয়েছেন নিজেদের পছন্দমত রাজমহল, দুর্গ, কেল্লা আর শেষ পর্যন্ত্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বারা পরিনত এক সুন্দর, পরিকল্পিত নগরে।

পুরোনো কেল্লায় পাওয়া প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ দিল্লির বয়স প্রায় পরিনত হরপ্পা সভ্যতার সাথে মিলিয়ে দিয়েছে। এরপর দিল্লির উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। পান্ডবদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ, সেও তো দিল্লি। পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজধানী দিল্লি, তার পর দাস, তুঘলক, খিলজি, লোধি, মুঘল সাম্রাজ্যের একের পর এক স্থাপন করা স্থাপত্যের নিদর্শন আজো সেই ইতিহাস বহন করে চলেছে।

ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণ আমার বরাবরের প্রিয়। ইতিহাসে পড়া চরিত্রগুলি কেমন করে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে এই সব স্থানে গেলে। দিল্লি আসার পর তাই সময় পেলেই বারবার ছুটে যাই কুতুবমিনার, লালকেল্লা, হুমায়ুন সৌধ, লোধি গার্ডেন এ। শুধু বেরিয়ে দেখে এসে সাধ মেটে না, সেই ইতিহাসের কাহিনী আরো পড়তে ইচ্ছে করে, সেই সব কেল্লার ভেঙ্গে যাওয়া ইঁটের পাথরের টুকরোর মধ্যে লেগে থাকা শত শত বছরের অজানা দীর্ঘশ্বাসের কথা জানতে ইচ্ছে করে। ভারতীয় পুরাতত্ম বিভাগের অসাধারন গবেষণায় প্রায় প্রত্যেকটি পুরোনো স্থাপত্যের সঙ্গের পরিচিতিজ্ঞাপক বোর্ডে ইতিহাস জানা যায় খুব সহজে, তবে সেই যুগের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল সেই যুগের পর্যটকদের লেখা ভ্রমণকাহিনী যা ব্রিটিশ ঔপনেবেশিক সরকার ও তার বেশকিছু অসামান্য কর্মচারীদের বদান্যতায় ইংরেজি ভাষায় অনুবাদে সহজবোধ্য।

ফিরোজ শাহ কোটলা
গত ১৪ই এপ্রিল ২০১২, শনিবারের ছুটির দিনে সপরিবারে বেড়িয়ে পরলাম ফিরোজ শাহ কোটলা দেখতে। ক্রিকেট স্টেডিয়াম এর দৌলতে এর নাম সবাই জানে। কিন্তু স্টেডিয়ামের পাশেই প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত দুর্গটি প্রায় অবহেলিত। দিল্লির নামকরা প্রসিদ্ধ স্থানের তালিকায় খুব সচরাচর চোখে পড়েনা এর নাম। একদিন ফক্স ট্রাভেলার নামক টিভি চ্যানেলটির সৌজন্যে একটু কৌতুহলী হলাম জায়গাটির জন্য।

ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন তুঘলক বংশের অন্যতম শাসক। ১৩০৯ সালে তিনি রাজপুত মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা ছিলেন দিপালপুরের রাজকন্যা। ১৩৫০-৫৪ সালে তার নির্দেশে ফিরোজাবাদ শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয় যার ধ্বংসস্তুপ এই ফিরোজ শাহ কোটলা। খুড়তুতো ভাই মুহাম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে বসেন। কুশলী শাসক হিসেবে সুনাম থাকলেও ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনকাল ছিল অস্থিরতায় ভরা। তার আমলে বাংলা-দিল্লির শাসন থেকে মুক্ত হয়। আরো কিছু এলাকার স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হন তিনি। ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন তার সময়ের অন্যতম বিলাসী ও উদার শাসক। বলা হয় ১ লাখ ৮০ হাজার দাসদাসীর অধিকারী ছিলেন তিনি। ধর্মীয় ক্ষেত্রে ফিরোজ শাহ ছিলেন উদারনীতির পক্ষপাতি। তিনি হিন্দুদের জিজিয়াকর থেকে অব্যাহতি দেন। উলামা সম্প্রদায়ের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখতেন এই সুলতান। হাত কাটার মতো নিষ্ঠুর শাস্তি রহিত হয় তার আমলে। বিদ্যা শিক্ষা উৎসাহিত করতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ফিরোজ শাহ হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নেন। কবরস্থান, শ্মশান, সরাইখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠায় উদারভাবে দান করতেন এই তুঘলক সুলতান।

ফিরোজ শাহ প্রথম মুসলমান শাসক যিনি ওড়িশা আক্রমণ করেন। বাংলা জয় না করতে পেরে ১৩৬০ সালে যখন তিনি দিল্লি ফিরে যাচ্ছেন, বিহারের জৌনপুরের কাছে একদম অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি ওড়িশা আক্রমণের চিন্তা করেন। মুসলিম লিপিকাররা জাজ-নগর বা ওড়িশার যে সম্পদের বিবরণ দিয়েছিলেন অতীতে, হয়ত সেটা ফিরোজ কে আকৃষ্ট করে থাকবে। অথবা বাংলা জয়ের আশা অপূর্ণ থাকার হতাশা থেকেও এই অভিযান হতে পারে। যাই হোক ডিসেম্বর ১৩৬০ বিহার থেকে তার সেই বিশাল বাহিনী মানভূম, সিংভূম জেলা হয়ে ওড়িশার দিকে ধাবিত হল। মানভূম জেলার ছোট ছোট ভূপতিরা এই আক্রমণ-এর মোকাবিলা করতে না পারলেও মানভূমের শিখর নামে একটি ছোট দুর্গ অধিকার করতে ফিরোজ বেশ বেগ পেয়েছিলেন। এরপর তিনি আরো দক্ষিণে ওড়িশার সীমান্তে তিনানগর নামে শহরে আক্রমণ করে ওড়িশায় প্রবেশ করলেন। পুরোন ময়ুরভঞ্জ রাজ্যের রাজধানী কিনিয়ানগর বলে একটি সমৃদ্ধ নগরীর লুন্ঠনের কথা জানা যায় সমসাময়িক লিপিমালায়, এই কিনিয়ানগর বোধহয় এখন খিচিং বা কিচিং। (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কাকাবাবুর একটি গল্পে কিচিং এর নাম আছে)। এরপর কেওনঝড় জয় করে তিনি কটকের দিকে অগ্রসর হলেন। রাজা ভানুদেব তৃতীয়, ভয়পেয়ে সারানগড়ের কেল্লা থেকে পালিয়ে গেলেন, সৈন্যরা প্রাণপণ লড়াই করেও শেষরক্ষা হল না, জয়ী ফিরোজ এগিয়েগেলেন পুরী-র দিকে। জগন্নাথ মন্দির আক্রমন করে তিনি দেবতাকে অপবিত্র করেন। চিল্কা হ্রদের তীরবর্তী গ্রামের মানুষের রক্তে হ্রদের জল লাল হয়ে যায়। ফিরোজ শাহ তুঘলকের এই ওড়িশা আক্রমণ ও পুরীর মন্দির অপবিত্র করা সারা ভারতে ঘৃণার জন্মদেয়। সমসাময়িক ঐতিহাসিক রা ফিরোজ এর সাফাই গাইবার অনেক চেষ্টা করলেও এই আক্রমণ ফিরোজের সফল সাম্রাজের এক কলঙ্কময় অধ্যায়।

সামস – ই – সিরাজ এর লেখা তারিখ-ই-ফিরোজশাহি থেকে এই ফিরোজাবাদের সুন্দর বর্ননা পাওয়া যায়। মূলতঃ তুঘলকাবাদের কেল্লার জলের অভাবের কথা মাথায় রেখে যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলে এই নতুন শহর। পুরোনো শহরের কেল্লা প্রাসাদের ভগ্নস্তুপ থেকে ইঁট, পাথর প্রাণীবাহী শকটে করে আনা হয়েছিল। রাই পিথোরা কেল্লা (পৃথ্বিরাজ চৌহানের কেল্লা) থেকে পাঁচ ক্রোশ দূরে অবস্থিত এই নতুন শহরে ফিরোজ শাহ নির্মাণ করলেন এক নতুন দুর্গ, কুশাক। স্যর আলেক্সান্ডার কানিংহাম এর মতে, “ফিরোজাবাদের প্রাসাদ ছিল নগর রক্ষা করার জন্য নির্মিত দুর্গের ভেতরে। বিশালাকায় পাথরের দেওয়াল ও তার মাঝে মাঝে মিশরীয় পিরামিডের ন্যায় ঢালবিশিষ্ট সুউচ্চ স্তম্ভ, কেল্লাকে সুরক্ষিত রাখত” এরকম একটিমাত্র দুর্গ প্রাকার আজ অবশিষ্ট আছে মহাকালের রথের চাকার থেকে বেঁচে, যা আজকের ফিরোজ শাহ কোটলার প্রবেশপথ।

টমাস ড্যানিয়েলের আঁকা এই ছবিতে ফিরোজাবাদ কেল্লার পশ্চিমদিকের দরজা দেখা যাচ্ছে। যদিও আজকের ফিরোজ শাহ কোটলায় এর কোন অস্তিত্ব নেই।

সামস ই সিরাজের বর্ননায় আছে – “অন্তত তিনটি সুড়ঙ্গ ছিল এই দুর্গ নগরে, রাজ-মহিলাদের যাতায়াতের জন্য। এই সুড়ঙ্গ গুলো এত বড় বড় ছিল যে, যাত্রীবাহী শকট ও তাদের মধ্যেদিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারত। একটি সুড়ঙ্গ ছিল পাঁচ জরিব লম্বা, নদীর সাথে সংযোগ ছিল তার, একটি ছিল শিকার প্রাসাদ কুশাক-ই-শিখর এর সাথে, প্রায় দুই ক্রোশ লম্বা, আর সবচেয়ে দীর্ঘটি ছিল পাঁচ ক্রোশ – কিল্লা রাই পিথোরা পর্যন্ত্য” হিন্দুরাও এর প্রাসাদের কাছে ও তার কিছুদূর উত্তরে দুটি অগভীর ফাঁকা স্থান হয়তো এই সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ ছিল। আশে পাশের কিছু পুরোনো অগভীর স্থানের ধংসস্তুপ সুড়ঙ্গে হাওয়া চলাচলের জন্য শ্যাফট হতে পারে বলে মনে করেছিলেন কানিংহাম।

ফিরোজাবাদের প্রাসাদে প্রধান আকর্ষনীয় দ্রষ্টব্য হল – সম্রাট অশোকের একটি স্তম্ভ যা ফিরোজ শাহ নিয়ে এসে কুশাক এ বসিয়ে তাঁর নতুন শহরের শোভা বাড়িয়েছিলেন, একটি জলের উৎস বা বাওলি এবং জামি মসজিদ।

পিরামিডাল গঠনের কাঠামোর উপর অশোকের স্তম্ভ।

ফিরোজাবাদের কেল্লার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই স্তম্ভ একটি বহিঃমঞ্চের উপর পিরামিডাল গঠনের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিচের তল এবং উপরের তলের বারান্দায় খিলানাকৃতি প্রকোষ্ঠগুলি দেখার মতো। সিরাজের বর্ণনায় চারদিকে চারটি গোলাকার গম্বুজের একটিও আজ সম্পূর্ণ অবস্থায় নেই। এই পিরামিডাল কাঠামো অশোকের স্তম্ভটিকে এখোনো দৃঢ় ভাবে ধরে আছে। মহম্মদ আনিম রাজি তার হাফত-ই-কালিম গ্রন্থ, যা আকবরের সময়ে রচিত, তাতে তিনতলা স্থাপত্যের উপরে এই স্তম্ভের বর্ননা দিয়েছেন।

বিন্দুসারের পুত্র এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পৌত্র মগধের সম্রাট অশোক (খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৫-২০০) কলিঙ্গযুদ্ধের পরে চন্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হলেন। বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী হয়ে সম্রাট অশোক বুদ্ধের শিক্ষায় হয়ে উঠলেন এক জনদরদি, প্রজাবৎসল রাজা। তাঁর সহনশীলতার নীতিকথা প্রচার করতেন বিভিন্ন শিলালিপিতে। কাবুল-কান্দাহার থেকে কলিঙ্গ মানে আজকের ওড়িশা পর্যন্ত্য অশোকের শিলালিপি পাওয়াগেছে। প্রায় প্রতিটি লিপিতেই পালি ভাষায় প্রিয়দর্শী অশোকের জনমুখী আইন-কানুন, নিয়ম নীতির কথা খোদিত করা হয়েছে।

বালি-পাথরের ৪২ ফুট ৭ ইঞ্চি দীর্ঘ একশিলা স্তম্ভটির উপরের ৩৫ ফুট মসৃনভাবে পালিশ করা। স্তম্ভটির ওজন আনুমানিক ২৭ টন। নিস্প্রভ গোলাপি রঙের এই স্তম্ভের উপরের ব্যাস ২৫.৩ ইঞ্চি এবং নিচের অংশের ব্যাস ৩৮.৮ ইঞ্চি। এই পরিমাপ অবশ্য বিভিন্ন সময়ের পর্যটক ও ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের বিবরণে ভিন্ন ভিন্ন। সামস ই সিরাজ বলেছেন ২৪ গজ বা ৩৪ ফুট, ১৮৩৭ সালে মেজর বাট ৩৫ ফুট, ফ্রাঙ্কলিন ৫০ ফুট, ভন অরলিচ ৪২ ফুট ইত্যাদি। অবশেষে স্যর আলেক্সান্ডার কানিংহামের আর্কিওলজিকাল সার্ভে সঠিক উচ্চতা নিরূপণ করে। স্তম্ভের উপাদান সম্বন্ধেও অনেক মতভেদ ছিল। স্তম্ভে খোদিত গ্রীক অক্ষরের উপস্থিতির জন্য দিনেমার উপদেষ্টা ডি লেট (de Laët) এই স্তম্ভকে আলেক্সান্ডার দি গ্রেট এর স্মৃতিস্তম্ভ বলেছেন, টম করিয়াট একে পিতল নির্মিত আলেক্সান্ডারের স্তম্ভ বলেছেন, চ্যাপলিন এডোয়ার্ড সেই মত সমর্থন করে একে মার্বেল এর তৈরি বলেছেন এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিশপ হেবার এটিকে মেহরৌলির লৌহস্তম্ভের মত এটিও ঢালাই ধাতুনির্মিত বলে মনেকরেছেন। তৈমুর দিল্লি আক্রমণ করার পর ফিরোজাবাদে এই মিনার বা স্তম্ভটি এবং দেখে বলেছিলেন “declared that all the countries he had traversed he had never seen any monument comparable to those”

এই স্তম্ভটি কিভাবে ফিরোজাবাদে নিয়ে আসা হয়েছিল তার কাহিনীও খুব উল্লেখযোগ্য। সামস-ই-সিরাজের বর্ননায় এত সুন্দরভাবে সেই ইতিহাস অসামান্য ভাবে ধরা আছে। ১৩৫৬ সালে ফিরোজ শাহ যখন এই স্তম্ভ নিয়ে আসেন ফিরোজাবাদে তখন সামস-ই-সিরাজের বয়েস ছিল ১২ বছর। সেই গল্প সিরাজের নিজের জবানিতে শোনা যাক –

“থট্টা অভিযান থেকে ফেরার পর সুলতান ফিরোজ প্রায়ই দিল্লির আশেপাশে প্রমোদ-ভ্রমণ করতেন। এইরকম দুটি জায়গায় দুটি পাথরের থাম বা স্তম্ভের সমন্ধে জানতে পারেন তিনি। একটি ছিল খিজিরাবাদ সালাউরা জেলার তবরা গ্রামে পাহাড়ের উপরে, আর একটি মীরাট শহরের সন্নিকটে। সেই পান্ডবদের সময় থেকে এই দুটি স্তম্ভ বছরের পর বছর দিল্লির কোন রাজা বা শাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই নিজ নিজ জায়গায় বিদ্যমান ছিল। ফিরোজ শাহর কৌতুহলী দৃষ্টি, প্রচুর সাধ্য সাধনায় এদের দিল্লিতে এনে ফিরোজাবাদের শোভাবর্ধনের কাজে লাগাল। অসাধারন দক্ষতা, শক্তিপ্রয়োগ ও উদ্যমের প্রচেস্টায় একটি বসানো হল ফিরোজাবাদের কেল্লার প্রাসাদে, জামি মসজিদের পাশে (আলোচিত স্তম্ভ), যার নাম দেওয়া হল মিনার-ই-জরীন (সোনার স্তম্ভ) এবং আর একটি শিকার প্রাসাদ কুশাক-ই-শিখর এ। লেখক পুরোনো ঐতিহাসিকদের বিবরণ পড়ে জেনেছেন, যে এই দুইটি স্তম্ভ নাকি আসলে পান্ডব দের মধ্যমভ্রাতা বিশালবপু ভীম এর হাঁটার জন্য ব্যবহৃত লাঠি ! সেই সময়ের কথা থেকে জানা যায় যে ভীম নাকি একাই হাজার জনের খাবার খেতেন আর তাঁর সাথে কেউ পেরে উঠত না। ভীম পঞ্চপান্ডবের ভাই হয়েও একাই অন্য ভাইদের চেয়ে শক্তিশালী ছিলেন। পঞ্চপান্ডবদের বাসস্থান এই জায়গার কাছাকাছি ছিল। ভীম নাকি একাই তার বৈমাত্রেয় এবং অসৎ ভাই (কৌরব) দের গবাদি পশু চড়াতেন এবং সে কাজে নাকি এই দুটি লাঠি তার পশুদের তাড়িয়ে একজায়গায় আনতে সাহায্য করত। সে যুগে নাকি পশুরাও মানুষদের মত বিশালাকায় ছিল, তাই এবিষয়ে সন্দেহর অবকাশ নেই। ভীম মারা যাবার পর এই দুটি লাঠি প্রস্তরীভূত হয়ে এই দুটি জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে যায়। ফিরোজ শাহ প্রথমবার এই দুটি স্তম্ভ দেখে সন্তোষ এবং প্রশস্তিবোধ করেন এবং প্রায় জয়লাভ করলে বিজয়ী যেমন বিজয়ের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যায়, সেইভাবে এদের ফিরোজাবাদে এনেছিলেন”।

“খিজিরাবাদ দিল্লি থেকে ৯০ ক্রোশ দূরে, পাহাড়ের সামীপ্যে অবস্থিত। ফিরোজ শাহ এই তবরা গ্রামে স্তম্ভটি প্রথমবার দেখেই এটিকে দিল্লি এনে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে স্থাপন করার জন্য মনস্থির করেছিলেন। অনেকচিন্তা ভাবনা করে স্তম্ভটিকে তুলে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরজন্য আশেপাশের সমস্ত গ্রাম খালি করানো হয়ছিল এবং সেই স্থানে শুধু পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল এবং তাদের প্রতি আদেশ জারি করা হয়েছিল সমস্ত প্রয়োজনীয় মানানসই সামগ্রী আনয়ন করার। শিমুল তুলোর রাশি রাশি মোড়কে স্তম্ভটি মুড়ে ফেলা হয়েছিল এবং মাটিতে তুলোর পুরু বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছিল যাতে স্তম্ভটির ভিত্তি থেকে যখন মাটি সরানো হল সেই সময় সেটি তুলোর বিছানায় মৃদুভাবে এসে পড়েছিল। স্তম্ভটির ভিত্তি পরীক্ষা করে দেখা গেছিল, এটি একটি চতুস্কোণ পাথরের উপস্তম্ভের উপরে বসানো ছিল। এটিকেও আনা হয় দিল্লিতে। এরপর যাতে স্তম্ভটি কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তার জন্য কাঁচা চামড়া দিয়ে আবৃত করে উপরে নলখাগড়ার নরম অংশ দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়েছিল। এই কাজের জন্য ৪২ চাকা যুক্ত একটি বিশেষ শকট যার প্রতিটি চাকা মোটা রজ্জুর প্রান্তের সাথে যুক্ত করে এক একটি দড়ি ২০০ জন মানুষের সবলে টানার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষের মিলিত প্রচেষ্টায় এটিকে যমুনার তীরে নিয়ে আসা হল। এখানে সুলতান নিজে এসে ব্যবস্থার তদারকি করলেন। বেশ কিছু বিশালাকার নৌকা জড়োকরা হল, এবং খুবই সুপ্রযুক্ত এবং সু-উদ্ভাবনকুশল অসীম শ্রম ও দক্ষতা সহকারে স্তম্ভটি যমুনার অপর পারে ফিরোজাবাদে নিয়ে আসা হল”

আরো গল্প আছে... লিখতে অনেক সময় লাগছে... তাই...

তথ্য ঋণ – ১)

২)
ক্রমশ......

No comments: