একটা মানুষের জীবনে পঁচিশ বছর বেশ বড় সময়কাল, জানি না কতদিন বাঁচব, তবুও প্রায় আমার জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময়কাল। আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর আগে, ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, বাবা মারা যান। মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগে নবাব বাহাদুর’স স্কুলে আমি তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র... প্রথমটা একটু হকচকিয়ে গেলেও খুব একটা দুঃখ পেয়েছিলাম বলে মনে করতে পারিনা, আসলে সেই হাসপাতালে বাবা কে ভর্তি করা থেকে ম্যাটাডোরে করে বহরমপুর শ্মশানে তাঁর দেহ দাহ করা পর্যন্ত্য একটা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। প্রতি বছরই পুজোর ঠিক আগে বাবা হাসপাতালে ভর্তি হতেন, আবার কয়েকদিন পরে ফিরেও আসতেন, কিন্তু এবার যে আর হাসপাতাল থেকে ফিরবেন না সেটা
বুঝতেও বেশ কয়েকদিন লেগেছিল। এরপর বহরমপুরেই আত্মীয়-স্বজন, বাবার অফিসের কাকুরা, আর বাবার কো-অর্ডিনেশন কমিটির সব চেনা লোকজনের মাঝে আমি ঠিক অনুভব করতে পারিনি কি হারিয়েছি... আর সেই সময় সমস্ত বাবা ছাই হয়ে যাবার পর, গঙ্গায় ডুবদিয়ে ভিজে সাদা কাপড়ে বাড়ি আসতেই মেজজেঠুর ছেলে রাজেশদাদা যখন তার সমস্ত গল্পের বইয়ের ভান্ডার অবলীলাক্রমে আমার হাতে দিয়ে দিল, সদ্য বাবা হারানো ছেলেটা তাতেই ডুবে গেল দিন দশেক। গাদা গাদা ছোট ছোট আনন্দমেলা, শুকতারার নেশায় সকালে কাঠের ধোঁয়ায় হবিষ্যি রান্না করাও খুব মজার সঙ্গে করেছিলাম, সেই দশ-বারো দিন, আমি প্রায় আমার তেরো বছরের জীবনে সবচেয়ে বেশী গোগ্রাসে গল্প গিলেছিলাম...
......
সব কিছু মিটে যাবার পর যখন ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস সংলগ্ন কোয়ার্টারটিতে ফিরে এসে কয়েকদিন আগে বাবার কিনে দেওয়া সাইকেলটা দেখে প্রথম আমার বাবার অভাব মনে হল, ভাবলাম বাবা যে বলে গেল হাসপাতাল থেকে এসে আমাকে সাইকেল শেখাবে, এখন সেটার কি হবে ? তার পর যখন স্কুল যাবার সময় বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ালাম...এই প্রথমবার একা একা... হটাৎ কোথা থেকে একরাশ কান্না এসে আমাকে বুঝিয়ে দিল, বাড়ির ভেতরে শোকাচ্ছন্ন মা থাকলেও, এই বাইরের জগতে আমি একেবারে একা...
...সেই শুরু হল আমার একা পথচলা... বারবার আছাড় খেয়ে রক্তারক্তি করে একা একা সাইকেল শেখা...আরো কত কি শেখা...
তবে সত্যিকরে উপলব্ধি করলাম নিজে বাবা হয়ে... প্রতি মুহুর্তে একটি একটি করে নতুন জিনিস শিখছি... আর একটু একটু করে সেই পঁচিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে বুঝতে পারছি...
সেই মানুষটা যার কাছে সর্বহারাদের পার্টি ছিল প্রথম সংসার, যে অবলীলাক্রমে তার মাস মাইনের টাকা ঘর পুড়ে যাওয়া রহেদ শেখ বা বন্যায় ফসল ভেসে যাবার পর হারান ঘোষের হাতে তুলে দিয়ে এসে স্ত্রীর গঞ্জনা শুনত, যার প্রিয় গান ছিল “ও আমার রক্তে ধোয়া ধান” আর “পথের ক্লান্তি ভূলে”,যে ছেলের পুজোর জামা কেনার টাকা দিয়ে পোস্টার লেখার রঙ তুলি নিয়ে চলে আসত, একাধারে লেখা, নির্দেশনা আর অভিনয়ে ব্যস্ত সেই নাটক পাগল লোকটা, যে ভগীরথপুর নামের এক অজ পাড়াগাঁয়ে প্রতিবছর দশমীর দিনে নতুন নতুন নাটকের আইডিয়ায় মত্ত থাকত, এক অতি সাধারণ পাজামা-পাঞ্জাবী পরিহিত গ্রামসেবক, যে চায়ের দোকানে মুড়ি খেতে খেতে সাধারণ মানুষদের মার্কসবাদ আর মাজরা পোকার কথা বলতে বলতে রাত কাবার করে বাড়ি আসত, আর রাতে ছেলেকে তার নিজের ছেলেবেলার দুষ্টুমির গল্প বলে তাক লাগিয়ে দিত, সেই বাবাটা যেন আরো বেশী বেশী করে আমার কাছের মানুষ হয়ে উঠছে...
কেমন ছিল সেই সব নাটক যা তিনি লিখে গেছেন ?
মণিমঞ্জিলের শুরুতে -
আর প্যালেস দি কাঞ্চন -
.
[ কলকাতা থেকে
কিছু দূরে কল্পিত এক পট ভূমিকায় নাটকের শুরু। পর্দা উঠলে দেখা যাবে “প্যালেস দি কাঞ্চনের” একটা হল ঘর। বাঁধারে একটা সিঁড়ি। সিঁড়ির ডানধারে একটা বড় দরজা। দরজার ভেতর
দিয়ে একটা বারান্দার কিছু অংশ দেখা যাবে।
রাত গভীর, স্টেজ প্রায় অন্ধকার। ঝড়ের শব্দ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কুকুরের ডাক শোনা যায়। কিছুক্ষণ পর
একটা মেয়ের ভয়ার্ত চীৎকার শোনা গেল – “পারব না, আমি কিছুতেই পারব না”। মেয়েটা সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে রেলিং ধরে হাঁপাতে লাগল। একটা আলো তার উপর পড়ে।
অন্য পাশে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, সারা দেহ কালো লং কোটে ঢাকা, মাথায় নাইট ক্যাপ,
চোখে গগলস, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি, হাতে একটা রিভলবার, মুখে চুরুট, পায়ে কালো
নাগরা। লোকটা সিঁড়ির দিকে পেছন করে দর্শকদের একপাশে রেখে দাঁড়িয়ে থাকবে। মেয়েটা
লোকটাকে দেখতে পায়নি। লোকটা হটাৎ দেশলাই জ্বালিয়ে চুরুট ধরায়। মেয়েটা ভয় পায়।
মেয়েটার নাম ‘মুন্নী’ – কলকাতার কুখ্যাত এলাকা থেকে তাকে এখানে
আনা হয়েছে। মুন্নীর বয়স ২৪/২৫, মেয়েটা মোটামুটি সুশ্রী।]
2 comments:
Baro bhalo likhechhis re. Khub bhalo laglo.
ইতিহাসে হারাই
স্মৃতিতে হারাই
মায়ায় হারাই।
Post a Comment